'সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব'(প্রপোরশনেট রিপ্রেজেনটেশন) প্রস্তাব সম্পর্কে দুই দলই সমান নীরবতা পালন করছে। কেউ মুখ খুলছে না। এ ব্যাপারে তাদের অভিন্ন অবস্থান।
আগে দেখা যাক, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি কী। বাংলাদেশে এখন একটি নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকা থেকে একজন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হচ্ছে। এভাবে তিনশ' এলাকা থেকে তিনশ'জন দলীয় বা স্বতন্ত্র সদস্য নির্বাচিত হয়। আর সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে বাংলাদেশ একটি নির্বাচনী এলাকা। নির্বাচনের আগে দলগুলো প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করবে। আর আসন পাবে দলের প্রাপ্ত ভোট অনুযায়ী। ধরা যাক_ বাংলাদেশে নির্বাচিত হবে ৩০০ সংসদ সদস্য। নির্বাচনে তিন কোটি ভোটার ভোট দিয়েছেন। এটিকে ৩০০ ভাগ করলে একজন সংসদ সদস্যের জন্য ভোটের অনুপাত এক লাখ। নির্বাচনে একটি দল ১০ লাখ ভোট পেয়েছে। দলটির দেওয়া প্রার্থী তালিকা থেকে ১নং থেকে ১০নং ব্যক্তি নির্বাচিত হবে। দেশভেদে আইনের কিছু হেরফের আছে।
প্রদেশ, বিভাগ বা জেলাভিত্তিক নির্বাচনী এলাকা করে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায়। যদি কোনো প্রদেশের ৫০, বিভাগের ২৫ বা জেলার ১০ জন হয়; সে অনুযায়ী দলগুলো আলাদাভাবে ওই এলাকার জন্য নির্দিষ্ট প্রার্থী তালিকা দেবে। যেখানে প্রার্থী ৫০, সেখানে এলাকায় প্রদত্ত সামষ্টিক ভোটের ৫০ ভাগের একভাগ ভোটে একজন সদস্য। সে অনুযায়ী দল এক ভাগ পেলে এক প্রার্থী, দুই ভাগে দুই প্রার্থী, তিন ভাগে তিন প্রার্থী...। অর্থাৎ দলের প্রাপ্ত ভোট অনুযায়ী আসন বণ্টন হবে।
যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে এলাকাভিত্তিক প্রতিনিধি নির্বাচন পদ্ধতি চালু আছে। পক্ষান্তরে জার্মানি, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস প্রভৃতি দেশ সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হচ্ছে। নেপাল ও শ্রীলংকা এখন সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি অনুসরণ করছে।
এলাকাভিত্তিক নির্বাচনের ত্রুটি হচ্ছে, সামান্য ভোটের ব্যবধানে আসন সংখ্যায় অনেক বেশি ব্যবধান তৈরি হয়। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনের কথা উল্লেখ করা যায়। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি ২৫২ আসনে সমগ্র ভোটের ৪০.৬৭ শতাংশ পায়, আর আওয়ামী লীগ পায় ৩০০ আসনে মোট ভোটের ৪০.১৩ শতাংশ। বিএনপির আসন ছিল ১৯২, পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগের মাত্র ৬২। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ২৬৪ আসনে প্রার্থী দিয়ে ভোট পায় ৪৮ শতাংশ। আর বিএনপি ২৬০ আসনে প্রার্থী দিয়ে ভোট পায় ৩২.৫০ শতাংশ। আওয়ামী লীগ ২৩০ আসনে জয়ী হয়, বিএনপির আসন ছিল মাত্র ৩০। দেখা যাচ্ছে, ভোটের ব্যবধানের চেয়ে আসনের ব্যবধান অনেক বেশি। এলাকাভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতিতে কোনো দল কম ভোট পেয়েও বেশি আসন পেতে পারে। এই পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ট ট্রাম্প পপুলার ভোট কম পেয়েও ইলেক্টোরাল কলেজে সংখ্যাধিক্য হওয়ায় নির্বাচিত হন। উল্লেখ্য, সংসদে সরকার ও বিরোধী দলের সদস্যদের মধ্যে আসনের ব্যবধানের কারণে রাজনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়। সরকার বেশিমাত্রায় কর্তৃত্বপরায়ণবাদী হয়ে ওঠে। তাছাড়া এলাকাভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট এলাকার ভোটে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়। প্রায়শই দেখা যায়, বিজয় ছিনিয়ে নিতে পেশিশক্তি ও টাকার খেলা চলে। অনেক ক্ষেত্রেই নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন ঘটে না। এমন প্রবণতা বাংলাদেশে প্রকট। এর ফলে সৎ ও ত্যাগীরা রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েছেন। রাজনীতি চলে গেছে টাকাওয়ালা ও আমলাদের কাছে। তারা টাকা ঢেলে এমপি-মন্ত্রী হচ্ছেন। নির্বাচন তাদের কাছে বিনিয়োগ। মতলব হলো, নির্বাচনে পাঁচ কোটি টাকা ব্যয় করবেন। এমপি-মন্ত্রী হয়ে শতকোটি টাকা তুলে আনবেন। এ প্রবণতা রোধ করতে হলে নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তন করতে হবে; কেবল ওয়াজ-নসিহত করে সম্ভব নয়।
সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে এভাবে পেশিশক্তি ও টাকার ব্যবহারের সুযোগ নেই। কোনো প্রার্থী পেশিশক্তি ও টাকা খাটিয়ে জয়ের স্বপ্ন দেখবে না; ফলে নির্বাচনে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগের কথাও ভাববে না। এই পদ্ধতিতে নির্বাচকমণ্ডলী নির্দিষ্ট কোনো প্রার্থীর জন্য ভোট দেয় না। যে কারণে আঞ্চলিকতা বা সাম্প্রদায়িকতাও নির্বাচনে প্রভাবক হবে না। ভোটারদের বিবেচনার মানদণ্ড হবে রাজনীতি, আদর্শ ও কর্মসূচি। নানা বিবেচনায় এটি এখন নির্বাচনের রোল মডেল।
সব পদ্ধতিরই নেতিবাচক দিক আছে। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিও এর বাইরে না। এই পদ্ধতি পার্টির মধ্যে গণতন্ত্র চর্চা না হলে আমলাতন্ত্র মাথাচাড়া দিতে পারে, জনবিচ্ছিন্ন ব্যক্তিরা নেতৃত্বে আসীন হতে পারে। আবার কোনো এলাকায় সংসদ সদস্য শূন্য হয়ে পড়তে পারে।
এসব বিবেচনায় এখন জার্মানিসহ কিছু দেশ মিশ্র পদ্ধতি অনুসরণ করছে। নেপালেও মিশ্র পদ্ধতি। সেটি হচ্ছে সদস্যদের একাংশ এলাকাভিত্তিক, অপরাংশ সংখ্যানুপাতিকভাবে নির্বাচিত হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হতে পারে ৩০০ আসনের এলাকাভিত্তিক ১৫০ ও সংখ্যানুপাতিক ১৫০। এ ক্ষেত্রে নির্বাচকদের দুই ভোট থাকবে। এক ভোট দেবে এলাকার প্রার্থীকে, অপর ভোট দলকে। তখন দেখা যাবে_ ১৫০ জন এলাকাভিত্তিক ও ১৫০ জন সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধি। দুইয়ের সমন্বয়ে সংসদ হবে। এ পদ্ধতিতে নারী প্রতিনিধিত্বের যথাযথ মূল্যায়নও সম্ভব। এ প্রসঙ্গে বলতে চাই, আমাদের সংসদে পরোক্ষ ভোটে নারী প্রতিনিধি নির্বাচনের যে বিধান রয়েছে, সেটি মর্যাদাকর নয়। বরং সে ক্ষেত্রে নেপালের বিধানটি বিবেচ্য হতে পারে। নেপালের পার্লামেন্টে এক-তৃতীয়াংশ নারী সদস্য। সে অনুযায়ী দলকে মনোনয়ন দিতে হয়। কোনো দলের এলাকা থেকে নারী সদস্যরা কম বিজয়ী হলে সে ক্ষেত্রে সে দলের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব আসনে নারী প্রার্থীকে অগ্রাধিকার দিতে হয়।
এখন আমরা দেখি, এলাকাভিত্তিক নির্বাচনে দলগুলো থেকে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের ব্যক্তিরা নির্বাচিত হয় না। যে কারণে বাজেট, আইনের খসড়া প্রণয়নে আমলা বা বাইরের বিশেষজ্ঞদের ওপর নির্ভর করতে হয়। এতে সমস্যা হয়। সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধির বিধানে বিশেষজ্ঞদের আসার সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি এখন দুই দলের কাছে জিম্মি। এর বাইরে রাজনীতিতে সৎ, ত্যাগী ও মেধাবীরা আছেন। পেশিশক্তি ও কালো টাকার দাপটে তারা সংসদে আসতে পারছেন না। অথচ তাদের সারাদেশে ছড়ানো-ছিটানো সমর্থক গোষ্ঠী আছে। তারা সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে বটেই, এমনকি মিশ্র পদ্ধতিতে সহজে বিজয়ী হতে পারেন। আর এরা সংসদে গেলে রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন আসতে পারে।
আশার কথা, দীর্ঘদিন ধরে সিপিবি, জাসদ, বাসদ, ওয়াকার্স পার্টিসহ বাম দলগুলো সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের প্রস্তাব করে আসছে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি ও ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্পধারাও বলছে। তবে বিষয়টিকে ইস্যুতে পরিণত করার কোনো চেষ্টা নেই। এটি যেন আর দশটা দাবির একটি। আর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এটিকে কোনো পাত্তা দিচ্ছে না। তবে দল দুটির কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেছি। এ ব্যাপারে তারা ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন।
নির্বাচন কমিশন পথরেখা (রোডম্যাপ) ঘোষণা করেছে। সেখানে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে নির্বাচনী আইনের পর্যালোচনা ও সংস্কারও আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রাজনীতিবিদ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা কথা বলবেন। কে কী বলবেন জানি না। তবে সংসদে প্রতিনিধিত্ব আইনের পরিবর্তনের কথা ভাবতে হবে। প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তন ভিন্ন নির্বাচন ও রাজনীতিকে দুর্বৃত্তায়নমুক্ত করার পথ নেই।
by
সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
|