কবি জীবনানন্দ দাশ ও তার বনলতা সেন কবিতা বাংলা সাহিত্যে একটি বহুল আলোচিত বিষয় । তার কাব্যে কারণে-অকারণে তরু-গুল্ম-লতা-পাতা ঝোপঝাড়ের এত বর্ণনা পাওয়া যায় যে তাকে কবি না বলে একজন অকৃত্রিম বনসংরক্ষক বা ফরেষ্ট গার্ড বলে ভ্রম হতে পারে। বাংলাভাষার কোন কবির সম্ভবত এত গাছপালার নাম-ধাম জানা নেই।তারই রচিত বনলতা সেন কবিতা বাংলা সাহিত্যে এবহুল আলোচিত বলেই এর ব্যাপক বিচার-বিশ্লেষণ প্রয়োজন। দীর্ঘদিন থেকে কবিতাটি একইভাবে পাঠ করা হচ্ছে। বেশীরভাগ পাঠক কবিতাটি সম্পর্কে পূর্ব-ধারণা নিয়ে কবিতাটি পাঠ করছেন। যার ফলে কবিতাটি তার বহুমাত্রিক ব্যাখা-বিশ্লেষণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।বনলতা সেনকে ঘিরে অনেক অমীমাংসিত প্রশ্ন নীচে তুলে ধরলামঃ
বনলতা সেন কি নারী না পুরুষ কবিতটিতে তা স্পষ্ট নয়।অন্ধকার বিদিশার নিশার মত চুল এবং শ্রাবস্তীর কারুকার্যের মত মুখ এবং পাখীর নীড়ের মত চোখ নারী/পুরুষ যে কারো থাকতে পারে। বরং দীঘল কেশ,কাজল-টানা চোখ এর কথা উল্লেখ থাকলে বনলতা সেন যে আসলেই একজন নারী তা নিশ্চিত হওয়া যেত।
বনলতা সেনের প্রতি কবির প্রেম কি একতরফা?
বনলতা কি শুধুই সৌন্দর্যময়ী না প্রেমময়ী?
জীবনানন্দের প্রতি বনলতা সেনের প্রকৃতই প্রেম নাকি একজন চরম হতাশাগ্রস্থ পুরুষের প্রতি সহানুভূতি?
শুধু চুল,মুখ ও চোখের বর্ণনা নারী দেহের সৌন্দর্য বর্ণনার জন্য যথেষ্ট কিনা ?
কবি বনলতা সেনকে কেন অন্ধকারে আকাঙ্খা করেন? [ ডঃ আকবর আলী, প্রাক্তন উপদেষ্টা,তত্ত্বাবধায়ক সরকার টিভি চ্যানেলে একই প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন]
বনলতা কি বিবাহিতা না কুমারী?
কবির সাথে এই সম্পর্ক কি পরকীয়া?
কবিকে দুদন্ড শান্তি দিয়েছিলেন বনলতা সেন, এই শান্তি কি শুধুই মানসিক নাকি মনোদৈহিক?
নাটোরের বনলতা সেন কবিকে দুদন্ড শান্তি দিয়েছিলেন,তবে কবি আর কোথায় শান্তি পেতে ব্যর্থ হয়েছেন?
নাটোরের বনলতা সেন এর সাথে কবির কি নাটোরেই দেখা হয়েছিল নাকি অন্য কোথাও
কবি যে সময়ের নাটোরের বনলতা সেন এর কথা বলেছেন সে সময়ে নাটোরে সেন বংশীয়া সম্ভ্রান্ত সুন্দরী রমণী বসবাস করতেন বলে জানা যায় না।
বনলতা সেন কবিতা জুড়ে একজন পর্যটকের বর্ণনা প্রাধান্য পেয়েছে নাকি একজন প্রেমিকের উচ্ছাস প্রাধান্য পেয়েছে?
কবি কি শুধুই ভ্রমণ-ক্লান্ত ছিলেন নাকি দেহে-মনে অতৃপ্ত ছিলেন?
বনলতার সাথে কবির এই মিলন দুটি অসমবয়সী নর-নারীর মিলন কিনা,কারণ দীর্ঘ পথচলার শেষে কবি বনলতা সেনের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন।
আর সেজন্যই কি অসমবয়সী কবিকে দুদন্ড শান্তি দিয়েই বনলতা সেন আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন?
কবি কি শেষ পর্যন্ত একজন প্রত্যাখাত পুরুষ ? জীবনানন্দ ছিলেন দাশ বংশীয় আর বনলতা ছিলেন সেন বংশীয়া- এ জন্যই কি বননলতা অসবর্ণ সম্পর্কে সম্মত হননি।
কবিকে বনলতা সেনের তির্যক প্র্রশ্ন এতদিন কোথায় ছিলেন? বনলতা সেন কি কবিকে সন্দেহ করতেন?
অন্ধকার বিদিশার নিশার মত চুল এবং শ্রাবস্তীর কারুকার্যের মত মুখ সার্বজনীন উপমা কিনা? [সোনালী চুল ইংরেজদের প্রিয় এবং সরল মুখশ্রী অনেকের পছন্দ]
অন্ধকার বিদিশার নিশা দ্বারা নিষ্প্রদীপ বিদিশা নগরীকে বুঝায় না।কাজেই ঘন-কালো চুলের উপমা হিসেবে এটা সঠিক নয়।
অন্ধকারে বনলতার সাথে সাক্ষাৎ করে বনলতার সৌন্দর্য সম্পূর্ণ অবলোকন করা সম্ভব কিনা?
অন্ধকারে কবির উপস্থিতি টের পেয়ে ও বনলতা কেন প্রদীপ জ্বালেননি ?
অন্ধকারের সাক্ষাৎ পর্বটি প্রচলিত নৈতিকতা-বিরোধী কিনা?
ডানায় রোদের গন্ধ মুছে ফেলে চিলরোদের রঙ এর জায়গায় রোদের গন্ধ লেখার মত ভুল তথ্য কি একজন কবির কাছ থেকে আদৌ প্রত্যাশিত ???
তাছাড়া কবির চিন্তাধারায় যথেষ্ট অসামঞ্জস্যতা বিদ্যমান। হাজার বছর পথ হাটার কথা বলে সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগরের বর্ণনা দিয়েছেন। মনে হয় কবি চিন্তার খেই হারিয়ে ফেলেছেন। তাহলে বলা উচিত ছিলহাজার বছর আমি জলে ভাসিতেছি পৃথিবীর জলে/সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগরে।
মালয় সাগরের আদৌ কোন ভৌগলিক অস্তিত্ব আছে কিনা?
কবির ভৌগলিক বর্ণনা প্রাচীন এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সীমিত তাহলে এই বর্ণনা কিভাবে সকল দেশ কালের পুরুষের প্রতিনিধিত্ব করে? এটি এশিয়াবাসী হতাশাগ্রস্থ পুরুষের নারীর কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ।
বনলতা সেন কবিতায় সাগর,হালভাঙা নাবিক,নদীর উল্লেখ থেকে সমুদ্রগামী জাহাজে দীর্ঘদিন নারীসঙ্গবর্জিত নাবিকদের কথা মনে আসে। এটি স্থলভাগের পুরুষের স্বগতোক্তি কখনো নয়। সার্বজনীন পুরুষ এখানে অনুপস্থিত।
কবি মাত্র্র হাজার বছর পৃথিবীর পথে হেটেছেন এ দ্বারা কবি হাজার বছরের পুরুষের কথাই বলেছেন,বক্তব্যটি সর্বকালের পুরুষকে ধারণ করেনি।
বনলতা সেন চরিত্রটি (সুন্দরী,অহংকারী,পুরুষবিদ্বেষী যিনি পুরুষকে দুদন্ড শান্তি দিয়েই ছুড়ে ফেলে দেন এবং স্থায়ীভাবে গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক
জীবনানন্দ চরিত্রটি (ভীতু,হতাশাগ্রস্থ,অতিমাত্রায় নারীপ্রেমিক যিনি নারীকেই শান্তি-স্বরূপা বলে মনে করেন,ঈশ্বর কিংবা প্রকৃতি তাকে কোন শান্তি দিতে পারে না
বনলতা সেন কবিতায় ধূসর জগত,অন্ধকার বিদিশার নিশা,থাকে শুধু অন্ধকার এসব বর্ণনা থেকে বলা যায় এটি একটি বিবর্ণ বর্ণের কবিতা।
আরো জানতে ভিজিট করুন
http://www.prothom-aloblog.com/blog/sfk808
প্রাক্তন মেট্রোপলিটন ম্যাজিষ্ট্রেট শফিকুল ইসলাম বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের উপসচিব।বেতার ও টেলিভিশনের গীতিকার। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: তবুও বৃষ্টি আসুক' শ্রাবণ দিনের কাব্য' মেঘভাঙা রোদ্দুর' দহন কালের কাব্য ও প্রত্যয়ী যাত্রা ।
|